মঙ্গলবার, ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
এ কে এস রোকন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার নামোসংকরবাটি গ্রামের সলেনুর বেগম। তার ভগ্নিপতি তালেব আলী ছিলেন শিবগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মোহরার। অবসরপ্রাপ্ত ভগ্নিপতির পেনসন চলাকালে মৃত্যুর পর বোনও মারা যান। ভগ্নিপতির পেনসনের অর্থ বোনের প্রতিবন্ধি একমাত্র মেয়ের নামে ব্যবস্থা করার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন ১৫ মাস।
বাড়িতে নিজের ও বোনের প্রতিবন্ধি দুই মেয়েকে নিয়ে এমনিতেই বিপাকে তার উপরে দীর্ঘ হয়রানীর একপর্যায়ে অভিযোগ করেন শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াতকে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি সমাধানের আহবানের দুইঘণ্টা পর নিজ কার্যালয়ের এজলাসে হামলার শিকার হন সাবরেজিস্ট্রার। আর এরই জেরে ভুক্তভোগী মহিলার চরিত্র হনন শুরু করে সাবরেজিস্ট্রারের অনুসারীরা। কথাগুলো বলতে বলতে এ ভাবেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সলেনুর। সংসারে অশান্তির আশঙ্কায় বিচার দাবি করেন ঘটনার।
কান্না জড়িত কন্ঠে তার দাবী, নিজ অফিসের কর্মচারীর কাজ তো অমানুষটা করেইনি, উল্টো তার জন্য সুপারিশ করতে যাওয়া একজন ইউএনও’র সাথে তাকে জড়িয়ে চরিত্র হনন মেনে নেয়া যায় না। সংসারের শান্তি ফিরিয়ে দিতে তিনি এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং সংশ্লিষ্টদের কঠোর বিচার দাবী তার। আর ভুক্তভোগী মহিলার বোনের একমাত্র মেয়ে ফারায়া ইয়াসমিন তমা এ প্রতিবেদকে কান্নায় জড়িয়ে ধরে অষ্পষ্ট স্বরে বলেন, ভাইয়া এমনিতেই আমি এতিম। আমার কাজটা স্যারকে করে দিতে বলেননা!
শুধু তমা বা তার খালা সলেনুরই নন। শিবগঞ্জের এ সাব রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলী অতিরিক্ত টাকা ছাড়া কোন দলিলেই স্বাক্ষর করেন না বলে অভিযোগ অসংখ্য ভুক্তভোগীর।
এমনকি গোরস্থান, মসজিদের জমি পর্যন্ত রেজিস্ট্রি করতে গেলে টাকা দিতে হয়। জমি নিবন্ধনের সব কাগজ ঠিক থাকলে একধরনের উৎকোচ আর ঠিক না থাকলে এর পরিমান বেড়ে কয়েকগুন হয়। ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ প্রতিদিন তার গড়ে দেড়শ দলিল থেকে পেতে হবে অন্তত ৫ লাখ টাকা। দীর্ঘ দিনের এ ক্ষোভ থেকেই ১০ জানুয়ারি হামলার শিকার হন তিনি।
আর দলিল লেখকদের কমিশন নিয়ে দরকষাকষির কারণে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মাসের কর্মবিরতির কারণে দলিল লেখকদেরও এক ধরনের ক্ষোভ বিরাজ করে। কর্মবিরতির আগে দলিল প্রতি বখরা ছিল ১৬শ টাকা আর তৎকালীন জেলা রেজিস্ট্রার ও তার চাপে বাধ্য হয়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮শ টাকা। প্রেক্ষিতে হামলার সময় পাশেই অবস্থান করা দলিল লেখকরাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে না আসায় গুরুতর আহত হন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অভিযোগ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াতের নির্দেশে দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা করেছে। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এছাড়াও সাব রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে শিবগঞ্জের সব জনপ্রতিনিধি, সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের সচিব জিল্লার রহমানের, ডাক্তার, বীরমুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় সাংবাদিক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী কিংবা সাধারণ মানুষেরও। তার দুর্নীতির লাগাম টানতে গত ৮ ডিসেম্বর উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় তলব করা হলে তিনি নিজেকে সুধরে নেয়ার আশ^াস দেন।
পাশাপাশি সভায় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, দুই ভাইস চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানগণ সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি, অনিয়ম ও সেবা প্রদানে সরকার নির্ধারিত ফি অপেক্ষা অধিক অর্থ দাবি করার বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করলে সাব রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে রেজুলেশনে করে সংশ্লিষ্ট কমিটি। তবুও তার পূর্বের আচরন না পাল্টে নিজের দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আবু তালেবের ফাইলটি ১৫ মাস ঝুলিয়ে রাখায় মানবিক কারনে অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউএনও নিষ্পত্তির আহবানে সাড়া না দেয়ার এক পর্যায়ে কর্মরত অবস্থায় হামলার স্বীকার হন তিনি।
এরপরই সাব রেজিস্ট্রারের অনুসারীরা অভিযোগ করে ইউএনও’র নেতৃত্বে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলার ঘটানা ঘটানো হয়েছে। প্রতিবাদে শুরু হয় দেশব্যাপি একদিনের কর্মবিরতি। এর জেরে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়রা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
অন্যদিকে সাব রেজিস্ট্রার এ্যাসোয়িশন তাদের দাবীতে অনড় থাকে। প্রশাসনের দুটি অংশ দুই মেরুতে অবস্থান নেয়ায় শিবগঞ্জ কার্য়ালয়ে চলছে অচলাবস্তা। মামলায় ১০-১২ জন অজ্ঞাত নামাদের দায়ী করে মামলা দায়েরের পর ৩ দলিল লেখককে গ্রেফতারের পর পুরো রেজিস্ট্রি অফিস চত্বর লোক শূন্য হয়ে পড়ে। ইউএনওকে দায়ী করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক সমাজ সহ ভুক্তভোগীরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভায় উত্তাল করে তোলে রেজিস্ট্রি অফিস চত্বর। এদিকে জেলা প্রশাসনের তদন্ত দল এবং নিবন্ধন অধিদপ্তরের একটি প্রতিনিধি দল পৃথক পৃথক ভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ভুক্তভোগীদের তোপের মুখে পড়ে।
সবশেষ মঙ্গলবার নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক উম্মে কুলসুম স্বাক্ষরিত এক আদেশের প্রেক্ষিতে বুধবার বিকালে জেলা রেজিস্ট্রার আফসানা বেগমকে নিয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক বীর জ্যোতি চাকমা, রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিদর্শক জিয়াউল হক সাব রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ওপর ভুক্তভোগীদের হামলার ঘটনায় সরজমিন তদন্তে আসেন।
খবর পেয়ে জড়ো হতে থাকেন ভুক্তভোগী, জনপ্রতিনিধি, বীরমুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এসময় তারা সাব রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ এনে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকে। একই সঙ্গে সাব রেজিস্ট্রারের শাস্তির দাবি জানিয়ে দ্রুত তাকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। পরে তোপের মুখে পড়ে বাধ্য হন ভুক্তভোগীদের লিখিত অভিযোগ নিতে এবং উপস্থিত সকলকে অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আশ^াস দেন।
দাদনচক গোরস্থান কমিটির সভাপতি আবু আহম্মেদ মুক্তা জানান, গোরস্থানের একটি জমি নিবন্ধন করতে গেলে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করা হয়। পরে তার নিকট আত্নীয় হাইকোর্টের বিচারপতির ফোনে ঐ জমি ৭ হাজার টাকায় নিবন্ধন করতে সমর্থ হন।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বজলুর রশিদ সনু জানান, সংশ্লিষ্ট দফতরের ইন্দনে দলিল লেখকদের কর্মবিরতি ব্যর্থ হলে তৎকালিন ইউএনও ও তার চেষ্টায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা ভেবে বিষয়টি মিমাংসা করে দেয়া হলে ঐ ঘটনার পর আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন সাব রেজিস্ট্রার। দলিল প্রতি বখড়া ১৬শ টাকা থেকে বেড়ে ১৮শ টাকায় দাঁড়ায়।
উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শিউলি বেগম বলেন, শ্বশুরের জমির দলিল করতে সাব রেজিস্ট্রার অতিরিক্ত টাকা চেয়েছিলেন। আমি যাওয়ার পরেও ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে তাকে।
সম্প্রতি নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহফুজ রায়হান জমির দলিল করতে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়েছেন সাব রেজিস্ট্রারকে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউসুফ আলি দাবী করেন, পরিকল্পিত ভাবে আনসারগণ তার কার্যালয়ের চত্বর ফাঁকা করে দিয়ে এবং ইউএনও তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ার কিছুক্ষণ পর তার উপর সন্ত্রাসী হামলা করানো হয়েছে।
আর তার স্ত্রী অরিনা বরকত খোদার দাবী তার স্বামী একজন সৎ কর্মকর্তা। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তার স্বামীর বিরু্েদ্ধ এসব মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে।
অন্যদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল হায়াত বলেন, সাব রেজিস্ট্রারের হয়রানির শিকার কোন পক্ষ এ হামলা চালাতে পারে। এর সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। ভুক্তোভোগীদের সমস্যা সমাধানের সুপারিশের কারনে হামলার সময় ঘটনাস্থলে না থাকলেও তাকে অন্যায়ভাবে জড়ানো হচ্ছে।
এবিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার আফসানা খাতুন বলেন, ‘আমরা সরকারি চাকরি করি, সবাই খুশি না, এটা সত্য। কিন্তু ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। জেলা রেজিস্ট্রার দাবি করেন, পেনশনের ফাইলপত্রকে কেন্দ্র করেই ইউসুফ আলীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খান।
আর সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট সাইফুল রেজা দুর্নীতি এবং সরকারী দায়িত্ব পালনের সময় হামলা দুটো ঘটনাকেই দুঃখজনক অ্যাখা দিয়ে বলেন, দীর্ঘ দিনের অনিয়ম দুর্নীতির লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়ায় এ ধরনের হামলা মোটেও কাম্য নয়। যেখানে হামলার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে সেখানে নিরীহ মানুষকে গ্রেফতারের কারনে এবং তদন্ত না করেই বাংলাদেশ সাব রেজিস্ট্রেশন অ্যাসোসিয়েশনের তাৎক্ষণিক দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তির কারণে মূল ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে।