শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
স্টাফ রিপোর্টার :
কোচিং বাণিজ্য যে রমরমা তা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে রাজশাহী শহরের অলিতে-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে অবৈধ কোচিং সেন্টার ও টিউটোরিয়াল হোম। একটি করে বিষয়ে পড়ানো, অগ্রীম ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা করে নিয়ে নেয়া শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এগুলো ওপেন বিষয় হলেও কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই এই অরাজকতা বিষয়ে। ফলে বেতনের বেশিরভাগ টাকাই চলে যাচ্ছে পড়া লেখার খাতে। সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। এছাড়া কোচিং গুলোরর শিক্ষকদের অনেক সময় খারাপ ব্যবহারের বিষয়ে জানাজানি থাকলেও কেউ অভিযোগ করতে চাননা। তবে এবার এক অভিভাবক মুখ খুলেছেন। তিনি জাহিদ ফিজিক্স এর পরিচালক মিস্টার জাহিদ উল ইসলামের বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার বোয়ালিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগে ছাত্রীর মা’ লিখেছেন, প্রতিদিনের ন্যায় আমার মেয়ে ৩ জানুয়ারী রাজশাহী নগর ভবনের পাশে অবস্থিত জাহিদ ফিজিক্স কোচিং সেন্টারে ক্লাস করতে যায়। কিন্তু রাস্তায় যানজট থাকার কারণে আমার মেয়ে ক্লাসে উপস্থিত হতে ১ মিনিট দেরি করে। এর আগে ক্লাসে প্রবেশ করেন ঐ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জাহিদ উল ইসলাম। তিনি আমার মেয়েকে ক্লাসে না দেখার এক পর্যায় তার বন্ধবীকে বলে তোমার বাটপার বান্ধবিটা ক্লাসে নেই কেন ?
আর ঠিক তখই আমার মেয়ে ক্লাসে প্রবেশ করে। এ সময় তার এক মিনিট দেরি হওয়াকে কেন্দ্র করে ঐ শিক্ষক আমার মেয়ের সাথে অসদ আচারণ করেন। যা শিক্ষানীতি পরিপন্থী। আবার সেদিন মেয়েকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন গতদিন কি তুমি ক্লাসে এসেছিলে ? মেয়ে উত্তরে না বলায় তিনি বিভিন্নভাবে অপমান সূচক ও তাচ্ছিল্য করে কথা শুনিয়ে দেন। এতে আমার মেয়ে অনেক কষ্ট পায়। অতঃপর সে বাসায় এসে আমাকে ঘটনা জানালে আমি জাহিদ স্যার কে মোবাইলে কল করে ঘটনা জানতে চাই। তখন তিনি উত্তরে বলেন, আমি ইযার্কি করে বলেছি। এরপর তিনি কথা শেষ না করে কলটি কেটে দেন।
সর্বশেষ ৫ জানুয়ারী বিকেল ৪ টায় আমার মেয়ে কোচিং করতে গেলে ক্লাস শেষে পূর্বের ঘটনা কেন আমাকে বলা হয়েছে এমনটি অভিযোগ এনে তিনি আমার মেয়েকে অফিসে ডেকে অপমান জনক কথা বলে এবং তাকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিতে চায়। এ ঘটনার পরক্ষনে আমার মেয়ে মোবাইল ফোনে আমাকে ঘটনাটি অবহত করলে আমি সেই কোচিং সেন্টারে যায় এবং শিক্ষক জাহিদ উল ইসলামের কাছে আমার মেয়ের অপরাধ জানতে চাই।
তখন তিনি অনুশোচনা না করে, দাম্ভিকতার সাথে বলেন, আপনার মেয়ে লেখা-পড়ায় অনেক ভালো। আমি চাই আরো ভাল করুক। কিন্তু তাকে ক্লাসে না দেখে আমি ইয়ারকি করে কথাটা বলে ফেলেছি। এ সময় আমার মেয়ে কোচিং সেন্টারে কান্না শুরু করে দেয়। তাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে নিরুপায় হয়ে আমি আমার মেয়েকে সাথে করে থানার শরণাপন্ন হই।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বোয়ালিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, যা কিছু ঘটেছে এটা নি:সন্দেহে অন্যায়। আমি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো ।
তবে উক্ত ঘটনা শুনে রাজশাহী কয়েকজন অভিভাবক বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট বা কোচিং না করলে নম্বর কম দেওয়া হয় পরীক্ষায়। শুধু তাই নয়, এমন অভিযোগও আছে যে, শিক্ষার্থীদের নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিংবা মানসিক নির্যাতন করে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা হয়। অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয় এসব কাজ করছেন মানুষ গড়ার কারিগররা। এ জন্য তাদের কোনো অনুশোচনা আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা এসব বিষয়ে সরকারের সু-দৃষ্টি কামনা করেন। যাতে করে পরবর্তীতে আর কোন শিক্ষক এমন ঘটনা ঘটাতে না পারে।
এদিকে শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দশ বছর আগে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে অনুসারে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এসব নীতিমালা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। শ্রেণিকক্ষে সংশ্লিষ্ঠ শিক্ষকরা যথাযথ ভাবে পাঠদান করেন না। তাদের আগ্রহ কিভাবে বেশি বেশি প্রাইভেট পড়িয়ে কিংবা কোচিং করে অঢেল উপার্জন করবেন। এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলে শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, বর্তমান সরকার এ বছর জাতীয় বাজেটে সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় দেখিয়েছেন শিক্ষাখাতে। অথচ দেশ ব্যাপী এই খাতেই সবচেয়ে বেশি অনিয়ম-দুর্ণীতি হচ্ছে। যাদের দায়িত্ব ঘরে ঘরে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালানো, জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত করা, তারা যদি অর্থলোভে এ রকম বাণিজ্য করেন, স্বীয় মান-মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেন, তাহলে তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে, কতটুকু জ্ঞান অর্জন করবে ? এক কথায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জিম্মি করে ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে শিক্ষকরা যে কোচিং রাজত্ব কায়েম করেছেন, অবিলম্বে তা বন্ধ করা প্রয়োজন । তা না হলে ব্যাপক মাশুল গুনতে হবে এ জাতিকে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ‘জাহিদ ফিজিক্স ’ কোচিং সেন্টার এর পরিচালক মিস্টার জাহিদ উল ইসলামের সাথে বৃহস্পতিবার(৫-জানুয়ারী) রাতে সাংবাদিক পরিচয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে তার কৃতকার্যের জন্য ভুল স্বীকার করেন।
সানশাইন / শামি