রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
স্পোর্টস ডেস্ক: রোহিত শর্মাকে বোল্ড করে মুষ্টিবদ্ধ হাত বাতাসে ছুড়লেন সাকিব আল হাসান। এক বল পর বিরাট কোহলিকে আউট করে তার সে কী উল্লাস! দুর্দান্ত ক্যাচ নেওয়া লিটন দাসের দিকে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন প্রবল আবেগে। মুখ থেকে হাসি যেন সরেই না! এই খুশি, এমন আনন্দ ইনিংস জুড়েই দেখা গেল সাকিবের চোখে-মুখে আর শরীরী ভাষায়। সেই প্রতিফলন পড়ল তার বোলিংয়েও। দুর্দান্ত বোলিংয়ে নাম লেখালেন তিনি রেকর্ড বইয়ে।
তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ভারতকে ১৮৬ রানে গুটিয়ে দেওয়ার মূল নায়ক সাকিব। মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে রোববার ৩৬ রানে তার শিকার ৫ উইকেট। এই পারফরম্যান্সে দারুণ এক রেকর্ড গড়া হয়ে গেছে তার। বাংলাদেশের হয়ে এই সংস্করণে সবচেয়ে বেশি বয়সে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি এখন তারই। ৩৫ বছর ২৫৫ দিন বয়সে এলো তার ৫ উইকেট। ৩৫ বছর ১৯৯ দিন বয়সের আগের রেকর্ডটি ছিল আরেকটি বাঁহাতি স্পিন গ্রেট মোহাম্মদ রফিকের। ২০০৬ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ফতুল্লায় সেদিন ৪৭ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
শুধু রেকর্ড গড়াই নয়, ক্যারিয়ারের একটি আক্ষেপের জায়গাও ঘুচিয়ে দিয়েছেন তিনি এ দিন। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হয়ে গেছেন তিনি অনেক আগেই। ক্রিকেট বিশ্বের নানা প্রান্তে কত অসাধারণ সব পারফরম্যান্স তার। ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি বিশ্ব ক্রিকেটের যে কোনো মানদণ্ডেও গ্রেট। তবে ভারতের বিপক্ষে বল হাতে তার পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো ছিল না। এই ম্যাচের আগে ভারতের বিপক্ষে ১৮ ওয়ানডেতে তার উইকেট ছিল ১৯টি। ইনিংসে ৪ উইকেট ছিল না একটিও। বোলিং গড় ছিল ৪০.০৫!
সাকিব যে মানের বোলার, এই বিবর্ণ রেকর্ড তার অহমে আঘাত করারই কথা। এবার শুধু ৪ উইকেটই নয়, ৫ উইকেটের সাফল্যে রাঙালেন নিজেকে। ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে বাঁহাতি স্পিনে ৫ উইকেট বিশ্বক্রিকেটেই আছে কেবল আর একজনের। ২০০২ সালে দিল্লিতে ৫৭ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অ্যাশলি জাইলস।
সব মিলিয়ে ওয়ানডেতে ৪ বার ৫ উইকেট হয়ে গেল সাকিবের। স্পর্শ করলেন তিনি আব্দুর রাজ্জাককে। বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে তাদের চেয়ে বেশি ৫ উইকেট আছে (৫ বার) কেবল মুস্তাফিজুর রহমানের। এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, কে বলবে, ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে নেমেছেন তিনি ৮ মাসেরও বেশি সময় পর!
গত মার্চে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর আবার ওয়ানডে খেলতে নামলেন তিনি ওয়ানডে। ম্যাচে প্রভাব রাখতে সময় নিলেন না খুব একটা। তার প্রথম ওভারটিই বলা যায় ইনিংসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ওভার। শুরুতে শিখর ধাওয়ানকে হারানোর ধাক্কা সামলে ভারত তখন গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। রোহিত শর্মাকে ক্রমেই হয়ে উঠছেন বিপজ্জনক। বল হাতে নিয়ে দ্বিতীয় বলেই দুর্দান্ত এক আর্ম ডেলিভারিতে সাকিব বোকা বানালেন ভারতীয় অধিনায়ককে।
টার্ন করবে ভেবে খেলতে গিয়ে এভাবে সাকিবের স্লাইডারে কত ব্যাটসম্যান যে আউট হলেন! বড় বড় নামও সেখানে আছে। যোগ হলো আরও একটি। এক বল পরই আরেকটি বড় সাফল্য। এবার তিনি বিরাট কোহলিকে চমকে দেন অফ স্টাম্পের বাইরে ঝুলিয়ে দেওয়া বল করে। কোহলি হয়তো অপেক্ষা করছিলেন স্টাম্প সোজা কোনো ডেলিভারির জন্য। জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাট বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে বল হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন ভারতের ব্যাটিং জিনিয়াস। বাকি কাজ সারেন লিটন। শর্ট কাভারে ডানদিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ এক রিফ্লেক্স ক্যাচ নেন তিনি।
তার তৃতীয় উইকেট ধরা দেয়, যখন দলের আবার প্রয়োজন উইকেটের। লোকেশ রাহুলের সঙ্গে ওয়াশিংটন সুন্দরের জুটি তখন জমে উঠেছে বেশ। যথারীতি হাত ধরেই মেলে স্বস্তি। সেখানে যদিও বড় অবদান ছিল ব্যাটসম্যানেরও। রিভার্স সুইপ খেলে উইকেট বিলিয়ে আসেন ওয়াশিংটন। ৬০ রানের সেই জুটি ভাঙার পর ভারত আর সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
সাকিবের পরের দুই উইকেট একই ওভারে। শার্দুল ঠাকুর ও দিপক চাহার এমনিতে বোলার হলেও ব্যাটের হাত মন্দ নয়। তবে যে দুটি ডেলিভারি তারা পেলেন, তাদের জন্য করার ছিল সামান্যই। সাকিবের সামনে হাতছানি ছিল আরও উইকেটের। তবে তার শেষ দুই ওভার সাবধানী ব্যাটিংয়ে পার করে দেয় ভারতের লোয়ার অর্ডার।
তাতে অবশ্য একটুও কমছে না তার পারফরম্যান্সের ওজন। সবচেয়ে বড় কথা, পুরনো সেই সাকিবকে যেন ফিরে পাওয়া গেছে এ দিন। বল হাতে তিনি বরাবরই নির্ভরযোগ্য, একটা মান তার সবসময়ই আছে। তবে কার্যকারিতা কিংবা উইকেট শিকারি প্রবণতায় যেন খানিকটা ভাটা পড়েছিল গত কিছুদিনে। যদিও তা অন্য সংস্করণে, তার পরও বল হাতে সাকিবের সেই ভীতি জাগানিয়া চেহারাটা যেন মলিন হয়ে এসেছিল অনেকটাই।
কিন্তু এই ম্যাচ নতুন করে সুখবর বয়ে আনল বাংলাদেশের ক্রিকেটে। টার্ন, বাউন্স, আর্ম ডেলিভারিসহ নানা বৈচিত্র আর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং মিলিয়ে সাকিব ছিলেন যেন নিজের সেই সেরা সময়ের চেহারায়। বোলিং-ফিল্ডিংয়ের প্রতিটি মূহূর্ত এ দিন তাকে উপভোগ করতে দেখা গেছে তাকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্যই, সাকিব যখন এভাবে উপভোগ করেন, তার পারফরম্যান্সও হয় ঝলমলে!