সোমবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
সানশাইন ডেস্ক: দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। চালের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এ কারণে এই পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা দেখা যায়। তারপরও ঢাকার বাজারে এখন মোটা চালের (স্বর্ণা) কেজি ৫৫ টাকায় উঠেছে, যা এক মাস আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। বাজারে নজর রাখা ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক কালে এই দর সর্বোচ্চ। এমনকি চালের বিকল্প খাদ্য আটার (খোলা) দামও এক মাসে বেড়েছে ২০ শতাংশ।
চালের মূল্যবৃদ্ধির হিসাবটি সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি)। বাজার ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। শুধু মোটা চাল নয়, টিসিবি বলছে, সরু ও মাঝারি চালের দামও বেড়েছে। তবে বাড়ার হার মোটা চালের চেয়ে কমÍ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ। টিসিবির সোমবারের হিসাবে, বাজারে এখন এক কেজি সরু চাল কেনা যাচ্ছে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা দরে। মাঝারি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে। আর মোটা চাল সর্বনিম্ন ৫৫, সর্বোচ্চ ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান নিজের একটি গবেষণার বরাত দিয়ে বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে মানুষ ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে মাঝারি চাল থেকে সরে মোটা চাল কেনা শুরু করে। এবার মোটা চালের দাম বেশি বাড়ার ক্ষেত্রে একটি কারণ হতে পারে, মানুষ মোটা চাল কেনা বাড়িয়েছে। এতে মোটা চালের বাজারে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।
ঢাকার বাজারে চালসহ নিত্যপণ্যের দামের হিসাব রাখে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তাদের দৃষ্টিতে সাম্প্রতিক কালে বাজারে চালের দাম কেমন ছিল দেখে নেওয়া যাক। তাদের হিসাবে ২০০৯ সালে ঢাকায় মোটা চালের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ২৩ টাকার কিছু বেশি। সরু চাল বিক্রি হতো সর্বোচ্চ ৪০ টাকা কেজি দরে।
টিসিবির হিসাবে, ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি ঢাকার বাজারে মোটা চালের দাম ছিল ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা, যা পাঁচ বছর পরে (২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি) ৩৮ থেকে ৪২ টাকায় দাঁড়ায়। অবশ্য মাঝে ২০১৭ সালের শেষ দিকে চালের দাম ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল। মোটা চালের কেজি উঠেছিল ৫০ টাকায়। এর কারণ ছিল হাওরে আগাম পানি চলে আসা ও অতিবৃষ্টির কারণে ফসলহানি। এরপর আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। এতে দাম কমতে শুরু করে।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় চালের কেজি ৩০ টাকায় নামে। এরপর যে বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়, তা আর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। দাম বাড়তে বাড়তে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের আড়তে গতকাল মোটা চাল (গুটি-স্বর্ণা) বিক্রি হয় ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে। আড়তদারেরা জানিয়েছেন, এই দর এক মাস আগে ৪২ টাকার আশপাশে ছিল। পাইকারিতে বিআর-২৮ ও সমজাতীয় মাঝারি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে। সরু চালের মধ্যে জনপ্রিয় মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৭ থেকে ৭০ টাকা দরে। আর নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৪ টাকা দরে।
কৃষি মার্কেটের বরিশাল রাইস এজেন্সির ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাজা বলেন, মিলমালিকেরা ধানের দাম বেড়ে যাওয়াকে চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। আর ট্রাকভাড়া বৃদ্ধিও একটি কারণ। এদিকে কুষ্টিয়া ও নওগাঁয় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি চার থেকে পাঁচ টাকা বেড়েছে।
রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে মোটা চাল (গুটি ও স্বর্ণা) প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায়। এখন মাঝারি বিআর-২৮ চালের কেজি ৬০ থেকে ৬২ টাকা। সরু মিনিকেট চালের কেজি ৭০ থেকে ৭২ টাকা এবং নাজিরশাইল ৮৪ থেকে ৮৬ টাকা দরে বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
মহাখালী বাজারের চাল বিক্রেতা ফিরোজ আলম বলেন, ‘দাম বেশি বলে কেউ কেউ দর-কষাকষি করে ফিরেও যাচ্ছেন। (সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত) মাত্র ২২ কেজি চাল বিক্রি হয়েছে।’ দাম কমাতে সরকার চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। আমদানি ব্যয় কমাতে গত ২৪ জুন করভারও ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও আমদানি হয়েছে সামান্যই।
খাদ্য অধিদপ্তরের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, গত ১ জুলাই থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আমদানি হয়েছে ৩২ হাজার টন চাল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল আমদানির শুল্ক কমানো হয়েছে। তবে মার্কিন ডলারের দাম অনেকটা বেড়ে গেছে। এতে আমদানি করে পোষানো যাচ্ছে না। খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, ভারত থেকে আমদানি করলে জাহাজ ভাড়াসহ দেশের বাজারে প্রতি কেজি সেদ্ধ চালের দাম পড়বে ৩৯ টাকা। আর থাইল্যান্ড থেকে আনলে দর দাঁড়াবে ৪৪ টাকার কিছু কম। এই দরের সঙ্গে অবশ্য শুল্ককর যুক্ত হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, চাল আমদানি না হওয়ায় সরকার এখন শুল্ক আরও কমানোর চিন্তা করছে। ৭ আগস্ট চালের শুল্ককর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার একটি প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে। খাদ্যসচিব ইসমাইল হোসেন সোমবার রাতে বলেন, মোটা চালের দাম কমাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে দাম কমতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, টিসিবি এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে যে তিনটি পণ্য দেয় (ভোজ্যতেল, ডাল ও চিনি) তার সঙ্গে চালও যোগ হবে। আর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়ানো হবে। অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এক কোটি দরিদ্র পরিবারের বাইরে আরও এক কোটি সীমিত আয়ের পরিবার দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। সরকার যে সহায়তা দেয়, তা এই ঝুঁকিতে থাকা এক কোটি পরিবারের কাছে পৌঁছায় না।
খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, সরকারের কাছে এখন প্রায় ১৬ লাখ ৭৪ হাজার টন চাল রয়েছে। গত বছরের এই সময়ে যা ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার টন। মজুত থেকে সরকার খোলাবাজারে (ওএমএস) ৩০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করছে। ঢাকায় চাল বিক্রির ট্রাকের পেছনে ভিড় বাড়ছেই। গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসস্ট্যান্ডের কাছে ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রির ট্রাকের কাছে গিয়ে দেখা যায় বিপুলসংখ্যক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও তখন পর্যন্ত ট্রাক থেকে চাল বিক্রি শুরু হয়নি। পরে বেলা পৌনে দুইটার দিকে গিয়ে দেখা যায়, তখনো শ’ দেড়েক নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
চাল কেনার জন্য অপেক্ষমাণ মনোয়ারা বেগম বলেন, বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। ওএমএসে কম দামে পাওয়া যায় বলে তিনি প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে চাল কিনেছেন। চাল কিনতে গিয়ে অত্যধিক ভিড়ের মধ্যে চাপাচাপিতে হাতে ব্যথাও পেয়েছেন। তবু ১০ কেজি চাল পেয়ে তিনি খুশি। মনোয়ারা খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালান। তার ভাই দিনমজুরের কাজ করেন। মনোয়ারা বলেন, পাঁচ কেজি চাল তিনি নিজের ভাইকে দেবেন। কারণ, তার ভাই চাল কিনতে পারেননি।
বাজারে এখন বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম চড়া। সরকারও জ্বালানি তেল, গ্যাস ও পানির দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়ানোয় বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। বাড়ানো হয়েছে সারের দাম। সব মিলিয়ে সংসারের ব্যয়ের চাপে মানুষের হিমশিম অবস্থা। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বহু পরিবার আছে, যাদের বাজার ব্যয়ের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ যায় চালের পেছনে। মানুষের অবস্থা যে খারাপ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোটা চালের দাম এতটা কখনো ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দাম এতটা দেখিনি। তবে ২০১৭ সালে ৫০-৫২ টাকায় উঠেছিল।’