রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
সানশাইন ডেস্ক : বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির প্রথম দুই সপ্তাহজুড়েই চলছিল চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি। তাই একুশ ফেব্রুয়ারির আগে মিটিং-মিছিলে ছাত্রদের পাশাপাশি আপামর মানুষের মাঝেও বিরাজ করেছে সংগ্রামী চেতনা। সেই সুবাদে সকলেই চাইছিলেন প্রতিরোধ কিংবা সরাসরি সংগ্রামের কর্মসূচী। আর এমন বাস্তবতায় ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে দেয় পূর্ববঙ্গ সরকার। নিষেধাজ্ঞা জারির সরকারী সেই নির্দেশে বলা হয়, ‘ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করিয়া এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি নিষিদ্ধ করিয়াছেন।’ আর আদেশ জারির অজুহাত হিসেবে বলা হয়, ‘একদল লোক শহরে সভা, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের প্রয়াস নেয়ায় এবং তদ্বারা জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই ব্যবস্থা অবলম্বিত হইয়াছে। কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, লালবাগ, রমনা ও তেজগাঁও থানার অন্তর্গত এলাকায় ইহা প্রবর্তিত হইয়াছে।’
জনমনে ভীতি ছড়াতে সেদিন চিরাচরিত কৌশল অবল গ্রহণ করেছিল সরকার। উল্টোদিকে ১৪৪ ধারা জারি করায় পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হয়। ফলশ্রুতিতে চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। সরকার একটি গুজবও ছড়িয়ে দেন যে হাসপাতালে নাকি অনেক শয্যাও খালি করা হয়েছে, যাতে একুশে ফেব্রুয়ারি শান্তিভঙ্গের কারণে যারা আহত হবেন তাদের ভর্তি করা যায়।
খরস্রোতা সেসব দিনের নানা তথ্য দিয়েছিলেন অলি আহাদ। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম এই সংগঠকের ভাষ্যমতে, সরকার একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচীর উদ্দেশ্য ছিল ওই অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। অলি আহাদ তখন আরেকটি কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, জহুর হোসেন চৌধুরী তখন মুসলিম লীগের বাংলা মুখপত্র ‘দৈনিক সংবাদ’ এর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। সেই সূত্রে সরকারী মহলে তার যোগাযোগ ছিল ভাল। একশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সরকারের মনোভাব যে কঠোর ছিল তা তিনি জানতেন। অলি আহাদকে তিনি খুব স্ন্নেহ করতেন। একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখটি যত এগিয়ে আসছিল জহুর হোসেন চৌধুরী ততই তাদের আইন ভঙ্গ করার চিন্তা বাদ দিতে বলছিলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি তার বাসায় তিনি অলি আহাদকে জানান, আন্দোলন দমন করতে সরকার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী তলব করবে, ট্যাঙ্ক ব্যবহার করবে। জবাবে অলি আহাদ বলেছিলেন, ‘দাসত্বের চেয়ে মৃত্যু ভাল।’
ইতিহাস বারংবার প্রমাণ করেছে যে শুধুমাত্র নৈতিক অবস্থানের কারণেই নিরাস্ত্র অথচ সংঘবদ্ধ মানুষের কাছে পরাজিত হয়েছে রাষ্ট্রবাহিনী। ভাষা আন্দোলনের সমর্থক হলেও জহুর হোসেন চৌধুরী আশঙ্কা করছিলেন একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের স্তব্ধ করতে গিয়ে সরকার হয়ত গণতন্ত্রের আন্দোলনকেই দমন করে ফেলতে পারে। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি। উল্টো একুশের উদ্দীপ্ত পথরেখায় এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা।