সর্বশেষ সংবাদ :

হিমেলের রক্তে রঞ্জিত ক্যানভাস

লাবু হক, রাবি: রোদেলা সকাল। মেহেগনির পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঠিকরে পড়ছে সূর্যের আলোর ঝিলিক। নিচে ক্লিপ দিয়ে তারের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা বেশকিছু ছবির ক্যানভাস বাতাসে দোল খাচ্ছে। শিল্পীর রঙ তুলির আঁচড়ে এসব ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে ট্রাক চাপায় পিষ্ট রক্তাক্ত হিমেলের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি ক্যানভাস যেন হিমেলের রক্তে রঞ্জিত। আর সকালের হিমেল বাতাস যেন ক্যানভাসগুলোকে নয়, বরং হিমেলের সেই ক্ষত বিক্ষত হৃদপিন্ডকেই পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত মাহমুদ হাবিব হিমেলকে ঘিরে আজ মঙ্গলবার শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হল সংলগ্ন মাঠে দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীতে শতাধিক শিল্পকর্ম প্রদর্শন করা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রদর্শনীর দক্ষিণ দিকে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা জলরঙে আঁকা বেশকিছু চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। মূর্ত ও বিমূর্ত উভয় ধাঁেচর চিত্রকর্মে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হিমেলের মৃত্যুর সেই ভয়াবহ দৃশ্য। পাশাপাশি শিল্পীর তুলির আঁচড়ে জানানো হয়েছে এই নির্মম ‘হত্যাকান্ডের’ প্রতিবাদ। প্রদর্শনীর উত্তর দিকে হিমেলের শিক্ষাজীবণে করা বেশকিছু শিল্পকর্ম নিয়ে করা হয়েছে হিমেল কর্নার। তার পূর্ব পাশেই বালি আর পাথর নির্মিত হিমেলের মাথাবিহীন মরদেহ শায়িত রয়েছে। এর পাশেই রয়েছে বালিতে নির্মিত ঘাতক সেই ট্রাকের নম্বর আর বালি আর কালো পাথরে নির্মিত শোকের প্রতীক।
এছাড়া ট্রাকের পিছনে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি ক্যানভাস। যেখানে লাল রঙের উপর অনেক মানুষ হাটছেন। হয়ত শিল্পী এই লাল রঙকে হিমেলের রক্ত বুঝিয়েছেন আর তার উপর হাঁটছে রাবির হাজারো শিক্ষার্থী। ট্রাকের উপরে কাঠ খোদই করা একটি মাথা কাটা একটি ভাস্কর্যের উপর ধাতব যন্ত্রাংশ নির্মিত একটি শিল্পকর্ম গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হিমেলের মরদেহ যে জায়গায় শায়িত ছিলো তার চতুর্দিকে ইটের বেড়া দিয়ে পাঁচটি পাথর খোদাইকৃত নারী ভাস্কর্য রাখা হয়েছে। যারা মাথার পেছনে হাত দিয়ে আর্তনাদ করছেন। এছাড়া তারই দক্ষিণ পাশে পোশাক পরিহিত অবিকল হিমেলের মরদেহ শায়িত রয়েছে। মরদেহের চতুর্দিকে রয়েছে ‘অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন’, ‘দায়িত্ব অবহেলা’, ‘অনিরাপদ ক্যাম্পাস’, ‘প্রশাসনের উদাসীনতা’ ও ‘অব্যস্থাপনা’ লিখা সম্বলিত পাঁচটি প্ল্যাকার্ড। তার একপাশে পোড়ামাটির তিনটি বানরের একটি চোখ ঢেকে রয়েছে, আরেকটি কান চেপে ধরে রেখেছে আর অন্যটি মুখ চেপে ধরে রয়েছে।
এ শিল্পকর্মটির বিষয়ে জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আল আমিন ইসলাম রওনক বলেন, এ শিল্পকর্মটি দেশের সার্বিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি সেক্টরে এই বিষয়টিই প্রতিয়মান হচ্ছে। এছাড়া প্রদর্শনীতে নিহত হিমেলের মৃত্যু পরবর্তী বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পারফর্মিং আর্ট প্রদর্শিত হয়।
প্রদর্শনীর বিষয়ে জানতে চাইলে চারুকলা অনুষদের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাকিলা খাতুন বলেন, হিমেল একজন সাংস্কৃতিমণা মানুষ ছিলো। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক অঙ্গসংগঠনের সঙে সে সম্পৃক্ত ছিলো। একজন চারুকলার শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে স্মরণীয় করে রাখাতে আজকের এই আয়োজন করা হয়েছে।
প্রদর্শনী দেখতে আসা দর্শনার্থী এফকে মলি ও নুসরাত জাহান কান্তা বলেন, আমরা হিমেল ‘হত্যাকান্ডটি’ স্বচক্ষে দেখিনি। তবে আজ চারুকলা শিক্ষার্থীদের এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে বুঝতে পারছি সেটি আসলে কতোটা ভয়াবহ ছিলো। পাশাপাশি চারুকলার শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুর জন্য এখন পর্যন্ত যেভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এটি আসলে অনেক প্রশংসনীয়। বন্ধুর বিপদে আমাদের এক হয়ে কাজ করা দরকার তারই এটি একটি অন্যতম উদাহরণ।
এর আগে, গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় রাবির হবিবুর রহমান হল সংলগ্ন রাস্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবীব হিমেল এক ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন। সে ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি জানানোর পাশাপাশি আলপনা এবং জলরঙে ছবি এঁকেসহ নানাভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন।


প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২২ | সময়: ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ