শনিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
তছলিম উদ্দীন, সাপাহার: শীত এবং নুতন বছরের শুরুতে সীমান্ত ঘেঁষা নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী জবই বিলে শত শত পরিযায়ী পাখির আগমনে সারা বিল এলাকা এখন পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও শীত শুরু হওয়ার সাথে সাথে দিন দিন অতিথি পাখির আগমন বেড়েই চলেছে। পাখি প্রেমীদের আগমনও ঘটছে সারা বিল এলাকাজুড়ে সারা দিন কেউ পাখপাখালি দেখেই কাটাচ্ছে আবার কেউ কেউ অত্যাধুনিক ক্যামারা দ্বারা ছবি তুলতেই ব্যাস্ত সময় পার করছেন, এমনই দৃশ্য দেখা গেছে সম্প্রতি বিল এলাকায় গিয়ে।
এলাকার বয়স্ক ও অভিজ্ঞদের মতে অতীতে কচুরিপানায় সারা বিল ঢেকে থাকায় সুদুর সইবেরিয়া সহ বিভিন্ন জায়গা হতে প্রায় সারা বছর অতিথি পাখি সহ বিভিন্ন জাতের পাখ পাখালিতে ভরপুর থাকত এই বিল। তখনকার দিনে দেশের রাজধানী ঢাকা সহ বিভিন্ন এলাকা হতে পাখি শিকারীরা বন্ধুক নিয়ে আসত এই বিলে। কালের ক্রমে দেশ বিভিন্ন শাসকের শাসনামলে জাল যার জলা তার নিতী অবলম্বন করায় একসময় বিলের সকল ঐতিহ্য হারিয়ে যায়। বিলের সকল কচুরিপানা বিলুপ্ত ও বিলে ধানের চাষাবাদ শুরু হওয়ায় পাখিরাও হারিয় যায়।
বিগত কয়েক বছর যাবত বিলটি একেবারে পাখিশূন্য অবস্থায় থাকে। বর্তমানে জাল যার জলা তার নীতি বাতিল করে বিলটিকে একটি বৃহৎ মৎস্য প্রকল্পের আওতায় এনে মৎস্যচাষ শুরু হয় বিলে। এরপর বিল পাড়ের কিছু শিক্ষিত বেকার যুবক জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা নামে একটি সংস্থা তৈরী করে বিলে পাখি সংরক্ষণের কাজ শুরু করে। এরপর ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) পরামর্শক্রমে ঐতিহ্যবাহী এই জবই বিলে গত ২০১৯ সাল হতে এই বিলে অবস্থানকারী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জরিপ শুরু করে। তাদের জরিপ মতে পরিযায়ী ও দেশী মিলে ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫৯৩টি, ২০২০ সালে ৭ হাজার ৬৮৩টি এবং ২০২১ সালে ৯ হাজার ৭১২টি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি অবস্থান করে এই বিলে।
জরিপ মতে ২১ সালে পরিযায়ী পাখির মধ্যে পাতি-সরালি ৪ হাজর, লালঝুটি-ভুতিহাঁস ২শ’, গিরিয়া হাঁস ১ হাজার ২শ’, পিয়াং হাঁস ১ হাজার, পাতি-তিলি হাঁস ২শ, টিকি-হাঁস ৫০, কালাপাখ ঠেঙ্গি ২০, গেওয়া-বাটান ৫০, প্রশান্ত সোনাগিরিয়া ২শ’, পাতি ভুতি হাঁস ৭৫০, কালা মাথা গাংচিল ৪, পশ্চিমা কানা কাপাসি ২টি, চখাচখি ১শটি।
দেশী প্রজাতির চা-পাখি ৪শ’ বেগুনি বক ২, কানি বক ৫০, বাজলা বক ৫০, গো-বক ৪২, শামুখ খোল ১ হাজার, পানকৌড়ী ২শ’, খাটো কান পেঁচা ২, বড় বক ১৫, মাছ মুরাল ২, সাপ পাখি ৩, ধুপনি ১শ’ কালা মাথা গাংচিল ৪, পশ্চিমা কানা কাপাসি ২, পাতি মাছরাঙ্গা ৫০, সাদা বুক মাছরাঙ্গা ১০টি সহ প্রায় ২৮ প্রজাতির পাখি জরিপে পাওয়া গেছে বলে জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান জানিয়েছেন।
এছাড়া সাপাহার উপজেলা সাপাহার উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল্যাহ আলমামুনের সাথে কথা হলে তিনিও বিলে একটি অভয়অশ্রম তৈরীর জন্য উপর মহলে জোর সুপারিশ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
পাখি সংরক্ষণকারী ও পাখি প্রেমীদের মতে দুঃখের বিষয় অতিতের মতো বিলে পাখি সংরক্ষন কিংবা আসা শুরু হলেও এর অবস্থান মাত্র কিছু সময়ের জন্য। মৎস্য প্রকল্পের মৎস্যশিকারীরা নির্দিষ্ট সময় পার হলে বিলে যখন মাছ ধরা শুরু করে ঠিক তখনই পাখিগুলি কোথাও কোন অভয়শ্রম না পেয়ে মনের দুঃখে আবার ফিরে যায় সুদুর দুর প্রান্তে।
কয়েক বছর যাবত বৃহত এই বিলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিলের নির্দিষ্ট কোন এক জায়গায় সরকারীভাবে একটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলার জন্য জবই বিল জীববৈচিত্র সংরক্ষন কমিটি সাপাহার উপজেলা প্রশাসন, বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন বিভাগ এছাড়াও বাংলাদেশ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ সংগঠন দাবী করে আসছেন।
তাদের দাবী এই বিলে সরকারীভাবে বিলের নির্দিষ্ট একটি অংশে অভয়াশ্রম ঘোষণা বা গড়ে তুললে সারা বছর সেখানে বিভিন্ন প্রজাতীর পাখি, বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছ, জীববৈচিত্র্যের হরেক রকম প্রাণী নিরাপদে বসবাস করতে পারবে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের নিকট তাদের দাবী অচিরেই বৃহৎ এই বিলে যেন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়, তা না হলে আর কয়েক দিন পরেই মৎস্য প্রকল্পের মৎস্যশিকারীদের মাছ ধরা উৎসব শুরু হয়ে যাবে। হয়তো বিলে আগত পাখিগুলো ধরে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়বে।