রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
সানশাইন ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী ও ব্যবসা খাতের সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় করোনাভাইরাস মহামারী বাংলাদেশের ‘বড় ক্ষতি করতে পারেনি’। নিউ ইয়র্কভিত্তিক সাময়িকী ফরচুনে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্য আসে।
‘উই রাইজ ফ্রম কোভিড-১৯ বাই হেলপিং দ্য নিডিয়েস্ট ফার্স্ট’ শিরোনামে ওই নিবন্ধে শেখ হাসিনা লিখেছেন, “বাংলাদেশও কোভিড-১৯ মহামারীর শিকার হতে পারত। কিন্তু আমরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী এবং ব্যবসা খাতগুলোকে সুরক্ষিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিই। তার ফলে মহামারী বাংলাদেশের ততটা ক্ষতি করতে পারেনি, যতটা অন্যান্য দেশের হয়েছে।
“আমরা বেশ ভালোভাবেই মহামারীর অভিঘাত থেকে উৎরে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারায় ফিরে আসতে পেরেছি, যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে এক দশক আগে।” শেখ হাসিনা লিখেছেন, কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার সরকারের প্রচেষ্টা ছিল, সবার আগে মানুষের প্রয়োজনের দিকে গুরুত্ব দিয়ে জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করা এবং তারপর সেইসব ব্যবসা খাতকে প্রণোদনা দেওয়া, যেখানে তারা কাজ করেন।
মহামারীর একেবারে শুরুতে অতি দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বাস্তুচ্যুত এবং দুঃস্থ নারীদের হাতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, “আমরা খুব দ্রুত নগদ অর্থ এবং অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি চার কোটি মানুষের হাতে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ। “এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে ২৮টি পৃথক প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে, যার আওতায় মোট ২২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছে, যা আমাদের জিডিপির প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশের সমান।
“এ ছাড়া টিকা এবং অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আমরা আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছি।” বিশ্বে দ্রুত ছড়াতে থাকা করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন যদি বাংলাদেশে হানা দেয়, তখনও সরকার জনগণের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই সব কিছু করবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি লিখেছেন, তার সরকারের নীতি হল- দেশে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না। এর আলোকে ১ কোটি ৬৮ লাখ পরিবারকে চাল, শিশুখাদ্য ও নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বয়স্ক প্রতিবন্ধী এবং দুস্থ ও স্বামী পরিত্যাক্ত নারীরা যাতে নগদ সহায়তা পায়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মহামারী শুরুর আগেই গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেই প্রকল্প বড় ধরনের অবদান রেখেছে বলে নিবন্ধে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
তিনি লিখেছেন, মহামারীর মধ্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং তার কর্মীরা যাতে সহায়তা পায়, সে বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে তার সরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নারী ও কৃষকরা এই সুবিধা পেয়েছেন। মহামারীর মধ্যে দীর্ঘ লকডাউনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল পর্যটন ও হসপিটালিটি ব্যবসা। এ খাতের কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্যও সরকার সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে, সে কথাও প্রধানমন্ত্রী নিবন্ধে লিখেছেন।
“বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও সহয়তা পেয়েছে: তৈরি পোশাক খাতের মত রপ্তানি-সংশ্লিষ্ট কারখানার কর্মীদের বেতন দিতে কয়েক দফায় আমরা কয়েকশ কোটি ডলার দিয়েছি।” উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে শিল্প কারখানার জন্য মূলধন জোগানো, সেই ঋণের সুদের একটি অংশ সরকারের তরফ থেকে বহন করা, ব্যবসার জন্য নেওয়া ঋণের সুদ নেওয়া স্থগিত রাখার কথাও প্রধানমন্ত্রী নিবন্ধে বলেছেন।
তিনি লিখেছেন, মহামারীর শুরুতে অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরার নিয়ম চালু করে। গত বছর মার্চের শেষ দিক থেকে জুন শুরু পর্যন্ত ৬৬ দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। তাতে শিল্প উৎপাদন বিঘ্নিত হয়, ছোট ও মাঝারি শিল্প বন্ধ থাকে। বৈশ্বিক লকডাউনে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতি ধাক্কা খায়।
“কিন্তু আমরা কখনো নিজেদের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাইনি। বরং আমারা মানুষকে সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রেখেছি। আমরা পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছি। সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে যারা গেছেন, তাদের আলাদা করেছি। আমরা সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন সুবিধা স্থাপন করেছি। আমরা ৬ হাজার ২০০ চিকিৎসক, ১০ হাজার নার্স ও ৩ হাজার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাকর্মী নিয়োগ দিয়েছি।
“আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও সেবা চালিয়ে যেতে পেরেছে; স্থানীয় পর্যায়ে বিগত বছরগুলোর যে বিনিয়োগ, তার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা লিখেছেন, “নতুন উদ্যোগ আর অতীতের বিনিয়োগের সম্মিলিত ফল হিসেবে অগণিত মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, দেশের অর্থনীতি এই দুর্বিপাক মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মোটা দাগে প্রায় ২ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পাঁচটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি।”
গত এক দশকে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়ে ২ হাজার ২২৭ ডলার হওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, “মহামারী আমাদের অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
তিনি লিখেছেন, “সত্যিই যাদের সাহায্য প্রয়োজন, তাদের সহায়তা করার প্রতি আমাদের অব্যাহত মনোযোগ স্পষ্টতই সুফল দিয়েছে। রাজনীতিতে নারী ক্ষমতায়নে ২০১৪ সালের পর থেকে আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের পিছনে ফেলে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে রয়েছে, সেজন্য আমরা গর্বিত।” বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২৩.৬৭ জনে নামিয়ে আনা, মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৭৩ এ নেমে আসার পাশাপাশি প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হওয়ার কথাও শেখ হাসিনা তুলে ধরেছেন।
“ডিজিটাল পদ্ধতির আত্মীকরণ এবং দক্ষতা অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সামনের সারিতে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ দেশের অর্থনীতির রূপান্তর ঘটিয়েছে, বৈচিত্র্য দিয়েছে। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইকেও এটা সহজ করেছে। এ দেশের সাধারণ মানুষও এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে। ফলে মোবাইলের মাধ্যমে তারা মহামারী সম্পর্কে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য পেয়েছে।” প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। সেখান থেকে এ বছর নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
“আমরা ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় উত্তরণের পথেই রয়েছি। শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মহামারীর পরও সেটা খুবই সম্ভব। আর এটা সম্ভব হয়েছে মানুষকে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমেই।”