সর্বশেষ সংবাদ :

‘হোটেল বয়’ সেই শিক্ষককে বাড়ি উপহার দিলেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা

মতলুব হোসেন, জয়পুরহাট: শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর অভাব-অনটনের সংসার চালাতে গিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েন রইস উদ্দিন টিপু। নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হোটেলে কাজ নেন তিনি। বিষয়টি নজরে আসার পর তাকে জমিসহ ঘর উপহার দিয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।
বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে প্রতিশ্রুতি ভিলা। গত শনিবার বিকেল ৪ টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রইস উদ্দিন টিপুকে জমিসহ ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে ওই শিক্ষকের হোটেলে কাজ করার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা হয়। বিষয়টি তার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে নাড়া দেয়।
জানা গেছে, রইস উদ্দিন টিপু ১৯৯৭ সালে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দীপুর ইউনিয়নের কানুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন পর তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন। ২২ বছর শিক্ষকতা জীবন পার করার পর ২০১৮ সালে তিনি অবসরে যান।
কিন্তু অবসর জীবনে পা দিয়েই সংসারে শুরু হয় অভাব-অনটন। স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার চালাতে বেকায়দায় পড়েন তিনি। শেষে স্থানীয় একটি হোটেলে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন।
এমন দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা হয়। তখন বিষয়টি তার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে নাড়া দেয়। তারা প্রিয় শিক্ষককে হোটেলে কাজ করতে দেখতে চান না। তাই বসবাসের জন্য তাকে কিনে দেন একখন্ড জমি এবং সেখানে নির্মাণ করা হয় বাড়ি।
এমনকি বাড়ি নির্মাণের আগে তিনি যে বাসায় ভাড়া থাকেন, ওই বাসার ভাড়াও দিচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রইস উদ্দিন টিপু সাংবাদিকে বলেন, শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর আমি সংসার চালাতে গিয়ে অভাব-অনটনে পড়ি। এরপর ঢাকায় যাই। সেখানে একটি কাজ নিই।
করোনাভাইরাসের কারণে আবার বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আবারও খুব কষ্টে পড়ে যাই। কোনো উপায় না পেয়ে জয়পুরহাট শহরের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ নিই। সেখানে সাত মাস কাজ করি। প্রতিমাসে বেতন হিসেবে তিন হাজার টাকা পেতাম।
বেতনের টাকা দিয়ে শহরের বিশ্বাসপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতাম। আমার রেস্টুরেন্টে কাজ করার ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এমন দৃশ্য দেখে আমার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আমার খবর নেয়। এরপর তারা আমাকে বিভিন্নভাবে উপকার করে। জমি কিনে সেখানে ইটের ঘর নির্মাণ করে দেয়। তাদের এই উপকার আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।
কানুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি ১৯৯৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী হিরো রহমান। তিনি বর্তমানে পুলিশে চাকরি করছেন। শিক্ষকের এমন পরিস্থিতি দেখে সহায়তা করার জন্য ওই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফোরাম নামে একটি সংগঠন করা হয়। সেই সংগঠনের আহ্বায়ক হিসেবে হিরো রহমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের প্রিয় শিক্ষক রইস উদ্দিন টিপু স্যার অবসরের পর একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এরপর থেকে তিনি দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিলেন। যা আমরা ফেসবুক-অনলাইনের মাধ্যমে জানতে পারি। প্রথমে আমাদের ছোট দুই ভাই ব্যবস্থা নেয় এবং আমাদের জানায়। তখন আমরা স্যারের জন্য কিছু করতে তাৎক্ষণিক ভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিই।
ফলশ্রুতিতে আমরা ২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর একটি মিটিং করে স্যারের জন্য কিছু করার কথা বলি এবং ফান্ড কালেকশন শুরু করি। সে সময় প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা কালেকশন হয়েছিল। পরে আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিলাম স্যারের স্থায়ী বসবাসের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। এজন্য একখন্ড জমি কেনা হয় এবং সেখানে বাড়ি নির্মাণ করে স্যারকে আজ হস্তান্তর করা হয়।ওই বিদ্যালয়ের এসএসসি ১৯৯৮ ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী হাফিজুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে মধুমতি ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র অফিসার পদে রংপুরে চাকরি করছেন।
তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় শিক্ষক হোটেলে কাজ করেন এবং জয়পুরহাট স্টেশনের পাশে এক এলাকায় ঝুপড়ি ঘরে ভাড়া থাকেন। এ খবরটি জানার পর আমরা শিক্ষার্থীরা ব্যাথিত এবং মর্মাহত হই। তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই স্যারের জন্য কিছু করতে পারি কিনা। আমরা স্যারকে আর হোটেলে কাজ করতে দেইনি। তাকে একটি ভাড়া বাসায় রাখি এবং প্রতিমাসে খরচ বাবদ নয় হাজার টাকা দেওয়া হয়।
বিদ্যালয়ের ১৯৯৮ ব্যাচ থেকে শুরু করে ২০২১ ব্যাচ পর্যন্ত সকল প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিলে টাকা জমিয়ে স্যারের জন্য একটি জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে প্রতিশ্রুতি ভিলা। আমরা স্যারকে এই বাড়িটি দিতে পেরে খুবই আনন্দিত এবং উৎফুল্ল।
অবসরপ্রাপ্ত ওই শিক্ষক রেস্টুরেন্টে কাজ করার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হৃদয়কেও নাড়া দিয়েছিল। তিনি পরে ওই শিক্ষকের হাতে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকার চেক দিয়েছিলেন।
আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল হাসান সাংবাদিকে বলেন, আজ আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওই শিক্ষককে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছি। নবনির্মিত বাড়িটিতে সুন্দর একটি বারান্দা করা হয়েছে। সেখানে কয়েকটি টেবিল ও বসার বেঞ্চ দেওয়া হবে। যাতে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতে পারেন। এছাড়াও তাকে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গে কথা বলে আনারারি শিক্ষক হিসেবে কাজ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, একজন শিক্ষকের বিপদে যেভাবে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছে, তা নতুনদের জন্য একটি ম্যাসেজ দিল যে শিক্ষা গুরুর অবস্থান অনেক ওপরে হওয়া উচিত।
এই ঘটনা থেকে শুধু ওই এলাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শেখার অনেক কিছু আছে। শিক্ষা গুরুর মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা বলে আমি মনে করি।


প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২০, ২০২১ | সময়: ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ | সুমন শেখ